সাহিত্যকর্ম অনুবাদে আমার বয়স ২৫ বছর। এই আড়াই দশকে প্রায় ২৫,০০০ পৃষ্ঠার ৭০টির কাছাকাছি বই অনুবাদ করেছি। এর মধ্যে পৃষ্ঠা সংখ্যা একশ’র নিচে এমন বইয়ের সংখ্যা মাত্র দুটি এবং তিন খণ্ডে একটি বইয়ের পৃষ্ঠা সংখ্যা ১৪০০’র বেশি। আমার সঙ্গে সরাসরি অথবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নতুন পরিচিত পাঠকরা জানতে চান তারা আমার অনুবাদ করা কোন বইটি প্রথম পাঠ করবেন। আমি কোনো দ্বিধা না করেই খুশবন্ত সিং এর “ট্রেন টু পাকিস্তান” পড়তে বলি। এরপর কোনটি পড়বো? আমি একই লেখকের ইতিহাস-ভিত্তিক উ্পন্যাস “দিল্লি’র কথা বলি। দুটি উপন্যাসই আমার অত্যন্ত প্রিয়। “ট্রেন টু পাকিস্তান” কেন আমার প্রিয়? কেউ যদি এটিকে প্রেমের কাহিনি বলেন, তাহলে ভুল হবে না; কেউ যদি ঐতিহাসিক বিবরণী বলেন, তিনিও ভুল করবেন না।

কিন্তু ‘ট্রেন টু পাকিস্তান’ প্রেম কাহিনি বা ঐতিহাসিক বিবরণীর চেয়েও বেশি। কারও পারিপার্শ্বিক অবস্থা যেমনই হোক না কেন, এবং পরিস্থিতি যতো কঠিন হোক না কেন, হাল ছেড়ে না দিয়ে কীভাবে টিকে থাকা যায়, মানুষ সহজাতভাবেই সেই সংগ্রামে লিপ্ত হওয়ার প্রেরণা পায়। ভারতের পরলোকগত খ্যাতিমান লেখক খুশবন্ত সিং তাঁর ‘ট্রেন টু পাকিস্তান’ তা চমৎকারভাবে তুলে এনেছেন।

‘ট্রেন টু পাকিস্তান’ এর কাহিনি সদ্য স্বাধীন ভারত ও পাকিস্তান এর সীমান্তবর্তী ছোট্ট এক গ্রাম ‘মানো মাজরা’কে কেন্দ্র করে আবর্তিত। গ্রামের পাশ দিয়ে গেছে শতদ্রু নদী এবং ছোট একটি রেলস্টেশন ছাড়া গ্রামটির আর কোনো বৈশিষ্ট নেই। প্রায় সমসংখ্যক শিখ ও মুসলিম অধ্যুষিত ‘মানো মাজরা’ ভারতে পড়েছে। পাকিস্তানে যখন ভারতমুখী ট্রেনের হিন্দু যাত্রীদের হত্যা করে ভারতে পাঠানো হচ্ছিল, ভারতের হিন্দু ও শিখরা ভারতে অবস্থানরত মুসলমানদের ওপর প্রতিশোধস্পৃহা চরিতার্থ করার প্রচণ্ড তাগিদ অনুভব করছিল। ‘মানো মাজরা’রা বাসিন্দারা তাদের সহাবস্থানের পরিবেশ পরিবর্তন না করতে বদ্ধপরিকর ছিল। কিন্তু পরিস্থিতি দ্রুত বদলে যায়, যখন গ্রামের একমাত্র হিন্দু বাসিন্দা অর্থ লগ্নিকারী মহাজনকে ডাকাতরা খুন করে। পুলিশ এ ঘটনাকে কাজে লাগিয়ে সীমান্তের এ পারের মুসলমানদের পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেওয়ার পটভূমি সৃষ্টি করে।

ইতোমধ্যে পাকিস্তানে হিন্দু ্রও শিখদের ওপর সহিংসতার খবর এমন অতিরঞ্জিত হয়ে ভারতে আসতে থাকে যে, ‘মানো মাজরা’য় মুসলিম পরিবারগুলোর জীবন রক্ষা করাও আশাহীনতায় পরিণত হয়। খুশবন্ত সিং দিল্লি ও লাহোরের রাজনীতি এড়ানোর প্রবল চেষ্টা করেছেন এবং ভারতবিভাগকে উপস্থাপন করেছেন মানবিক দৃষ্টিকোন থেকে। ডাকাতের হাতে হিন্দু মহাজনের হত্যাকাণ্ডের রাতে মানো মাজরা’র সুগঠিত দীর্ঘদেহী তরুণ শিখ ডাকাত জুগ্গা অন্ধ মুসলিম তাঁতির উঠতি বয়সী কন্যা নূরানের সঙ্গে গ্রামের পাশেই প্রণয়ে লিপ্ত ছিল। পরদিন পুলিশ সন্দেহবশত জুগগাকে ধরে নিয়ে যায়। সেদিনই সকালে দাড়ি-পাগড়িহীন ‘ইকবাল’ নামে এক তরুণ শিখ কমিউনিস্ট দিল্লি থেকে মানো মাজরায় আসে সীমান্ত এলাকায় সম্ভাব্য দাঙ্গা প্রতিরোধে দলের পক্ষ থেকে ভূমিকা রাখতে। ‘ইকবাল’ নামটি যেহেতু মুসলমানদের মাঝেও আছে, গোলযোগপূর্ণ পরিস্থিতি বিস্ফোরণোন্মুখ এক গ্রামে তার আগমণকে সন্দেহজনক বিবেচনায় পুলিশ তাকেও গ্রেফতার করে।

এমন এক পরিস্থিতিতে কী হবে ‘মানো মাজরা’ গ্রামের? সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা কী এক সময়ের শান্তিপূর্ণ গ্রামটিকে গ্রাস করবে? গ্রামের মুসলিম পরিবারগুলোর ভাগ্যও কি পাকিস্তানে হিন্দুদের পরিণতি ভোগ করবে? জুগ্গা ও নূরানের প্রেম কাহিনি অনবদ্য। উভয়ের দৈহিক সম্পর্কের জের হিসেবে নূরান গর্ভবতী হয়ে পড়েছিল। যেদিন পুলিশ মুসলিম পরিবারগুলোকে পাকিস্তানে পাঠানোর আগে উদ্বাস্তু শিবিরে নিয়ে যাবে, সেই সন্ধ্যায় নূরান জুগগার বাড়িতে এসে তার মাকে জানায় যে সে গর্ভধারণ করেছে। জুগগার মায়ের কী করার আছে। জুগগা তো পুলিশ হেফাজতে। হতাশ নূরান চলে যায়। যেদিন মুসলিম পরিবারগুলোকে ট্রেনে উঠিয়ে পাকিস্তানের উদ্দেশে পাঠানো হবে, সেদিন বিকেলে পুলিশ জুগগাকে ছেড়ে দেয়। জুগগা জানতে পারে, মুসলিম রক্তে হাত সিক্ত করতে দাঙ্গাবাজ হিন্দুরা ট্রেন আটকানোর পরিকল্পনা করেছে। ব্রিজে রশি বেঁধে দিয়েছে যাতে ছাদে আরোহণ করা যাত্রীরা রশির সঙ্গে লেগে ছিটকে পড়ে, এরপর তারা তাদের গুলি করতে হত্যা করবে। জুগগা বেপরোয়া হয়ে ওঠে। এই ট্রেনে থাকতে পারে তার প্রেমিকা নূরান। তাকে সে দাঙ্গার বলি হতে দিতে পারে না।

সন্ধ্যার অন্ধকারে সে ব্রিজ বেয়ে ওঠে কৃপান দিয়ে রশি কাটতে শুরু করে। রশি কাটার কাজ যখন প্রায় শেষ পর্যায়ে তখন ট্রেন আটকানোর পরিকল্পনাকারীরা তাকে দেখতে পেয়ে তাকে লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়ে। সে আহত হয়, কিন্তু ট্রেন রশির কাছে পৌছার আগে রশি কেটে ফেলতে সক্ষম হয় এবং ট্রেনটি নিরাপদে পাকিস্তানে চলে যায়।

পাঠকদের আমি সবসময় ‘ট্রেন টু পাকিস্তান’ পাঠ করার পরামর্শ দেই। ভার-বিভাগকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট মানবিক বিপর্যয়কে খুশবন্ত সিং যেভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তা ইতিহাস পাঠে যারা ক্লান্তি বোধ করেন তাদেরকে উপমহাদেশের ইতিহাস পাঠে উদ্বুদ্ধ করবে বলে আমার বিশ্বাস।

আমার অনুবাদে ‘ট্রেন টু পাকিস্তান’ ২০০২ সালে প্রথম প্রকাশ করেছিল ‘ঐতিহ্য’। ২০১৬ সাল থেকে প্রকাশ করছে ‘নালন্দা’। বইটির প্রচ্ছদ তেমন আকর্ষণীয় হয়নি। নালন্দার সত্ত্বাধিকারী রেদওয়ানুর রহমান জুয়েল আশ্বাস দিয়েছেন, আগামী বছর প্রচ্ছদ পাল্টে দেবেন।